ক্যান্সার প্রতিরোধের খাবার
ক্যান্সার প্রতিরোধের খাবার
ক্যান্সার প্রতিরোধের খাবার
ক্যান্সার ‘মরণ ব্যাধি’ এটা আমরা সকলেই জানি । আর এই মরন ব্যাধিও যে প্রতিরোধ করা যায় এটা হয় তো অনেকে বিশ্বাস করতে চাই না। কিন্তু এই মরণ ব্যাধিও প্রতিরোধ করা সম্ভব কিছু খাবারের মাধ্যমে। শুনে অবাক হওয়ার কিছু নেই। দিন যত যাচ্ছে ততই রোগের প্রতিকারের নিত্যনতুন গবেষণা ও চিকিৎসায় পরিবর্তন আসছে। তবে সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার আগে তা সমাধান করাই সবচেয়ে বেশি উত্তম হিসেবে বিবেচিত। বর্তমানে ডাক্তাররা পুষ্টিকর খাদ্যের মাধ্যমেই বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধের কথা বলছেন। এমন কিছু খাবার আছে যা মরণব্যাধি ক্যান্সার প্রতিরোধ করে থাকে। তাই প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় এই খাবারগুলো রাখা হলে এবং তার সাথে নিয়মিত ব্যায়াম করলে ক্যান্সারকে দূরে রাখা সম্ভব। ক্যান্সারের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের আছে। তার মধ্যে বর্তমান সময়ে স্তন ক্যান্সার এর প্রকোপ দিনদিন বেড়ে চলছে। তাহলে চলুন ক্যান্সার প্রতিরোধ করবে এমনই কিছু খাবারের নাম জেনে নেওয়া যাক।
ক্যান্সার প্রতিরোধ করবে যে খাবার গুলো
১। গাজর
গাজর অনেক পুষ্টিগুণ ও ভিটামিনে ভরপুর খাদ্য। আর এই গাজরে প্রচুর পরিমাণে বিটা ক্যারটিন আছে যা বিভিন্ন ক্যান্সার যেমন ফুসফুস ক্যান্সার, শ্বাসনালী ক্যান্সার, পাকস্থলী ক্যান্সার, অন্ত্র ক্যান্সার এমনকি স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধ করে থাকে। প্রতিদিন একটি গাজর বা এক গ্লাস গাজরের রস পান করলে এই সকল ক্যান্সার প্রতিরোধ করা সম্ভব।
২। রসুন
অনেক গবেষণায় দেখা গেছে যারা রসুন খান তাদের ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কম থাকে। এটি ক্যান্সারের জীবাণু প্রতিরোধ করে। এমনকি কিছু ক্যান্সারের জীবাণু ভেঙ্গে ফেলে। তাই প্রতিদিন একটি খোয়া রসুন খান, এটি আপনার ভেতরের ক্যান্সারকে প্রতিরোধ করবে।
৩। টমেটো
টমেটো এক প্রকারের ফল, আবার অনেকে একে সবজি বলে কারন এতে বীজ আছে তাই। কিন্তু এতে মসলাদার সুগন্ধের জন্য সবজি হিসেবেও ব্যবহৃত হয় বেশি। টমেটো ফল না সবজি সেটা কোন বিষয় না। টমেটো হচ্ছে “নিউট্রিশনাল পাওয়ারহাউজ” যা ক্যান্সারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারে। টমেটোতে লাইকোপেন নামের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে যা হৃদরোগ প্রতিরোধেও সাহায্য করে থাকে। টমেটোতে ভিটামিন এ, সি, এবং ই থাকে যা কিনা ক্যান্সার বান্ধব মৌলের শত্রু। টমেটোর রস ক্ষতিকর ডিএনএ এর কোষ নষ্ট করে ফেলে। তাই সপ্তাহে ২ থেকে ৩ টি টমেটো খাদ্য তালিকায় রাখা উচিত।
৪। বাদাম
বাদামে প্রচুর পুষ্টিগুণ থাকে। আর হৃদপিণ্ডের সুস্থতার জন্য প্রয়োজনীয় ফ্যাট থাকে বাদামের মধ্যে। যদি আপনি ক্যান্সারের সাথে সম্পর্কযুক্ত ক্ষুধাহীনতায় ভুগে থাকেন অথবা ওজন কমাতে চান তাহলে বাদাম সবচেয়ে ভাল, কারণ অল্প পরিমাণ বাদাম আপনাকে অনেক পরিমাণ পুষ্টি প্রদানে সক্ষম। বাদামে স্বাস্থ্যকর ফ্যাট থাকার পাশাপাশি পটাশিয়াম, আয়রন, জিঙ্ক, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, ম্যাগনেসিয়াম, ফোলেট, সেলেনিয়াম এবং ভিটামিন ই থাকে। এছাড়াও কিছু প্রোটিন ও ফাইবারও থাকে। আখরোট প্রদাহ রোধী ওমেগা৩ ফ্যাটি এসিডের চমৎকার একটি উৎস। কিছু গবেষণায় জানা গেছে যে, সাপ্লিমেন্টের চেয়ে খাদ্য থেকে এই পুষ্টি উপাদানটি শোষণ করা ভালো। বাদামে সেলেনিয়াম নামক অ্যান্টি ক্যান্সার উপাদান বিদ্যমানের কারনে কোলন, ফুসফুস, যকৃত, এবং অন্যান্য ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে যায়। তাই সকালে কিংবা বিকালের নাস্তায় চিনাবাদাম রাখতে পারেন। এ ছাড়াও বাদামের মাখনও আপনার শরীরকে ক্যান্সার থেকে দূরে রাখতে পারবে।
৫। হলুদ
আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটি এক গবেষণায় বলা হয়েছে হলুদে ‘কারকিউমিন’ নামক উপাদান আছে যা ক্যান্সার প্রতিরোধ করে থাকে। এছাড়া এটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা দেহের টিস্যুর মধ্যে প্রবেশ করে ভেতর থেকে দেহকে ক্যান্সার প্রতিরোধী করে তোলে। প্রতিদিন কাঁচা হলুদের দুধ, বা মাছ ও মাংসের মত তরকারিতে প্রয়োজন মত হলুদ ব্যবহার করতে পারেন। হলুদ ক্যান্সার কোষকে শরীরের ভাল কোষকে নষ্ট করতে বাধা দেয় এবং ক্যান্সার কোষকে নিস্তেজ করতে সাহায্য করে। সুতরাং নিয়মিত খাদ্যের মধ্যে হলুদ খেতে চেষ্টা করবেন।
৬। গ্রিন টি
গ্রিন টি বা সবুজ চা ক্যান্সার প্রতিরোধে অনেক উপকারি। এই সবুজ চায়ে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ক্যাটচীন নামক উপাদান থাকে, যা বিভিন্ন ক্যান্সার প্রতিরোধ করতে সক্ষম। গবেষণায় আরো দেখা গেছে গ্রিন টি টিউমার হওয়া প্রতিরোধ করে থাকে। সাধারণ চায়ের চেয়ে গ্রিন টি বেশি উপকারি। তাই চা না খেয়ে গ্রিন টি বা সবুজ চা খেতে পারেন।
৭। ফুলকপি বা ব্রকোলি
ফুলকপি ও ব্রকলি অত্যন্ত পুষ্টিকর এবং ভেষজ উপাদান সমৃদ্ধ একটি সবজি। ফুলকপি, বাধাঁকপির মত ব্রকোলি একটি আঁশযুক্ত সবজি যা শরীরের বিষাক্ত পদার্থ দূর করে থাকে। এছাড়া গ্যালাকটোজ উপাদান অন্ত্রে ব্যাকটেরিয়ার দূর করতে অনেক সহায়ক। ব্রকলির সালফোরোফেন, ইনডোলস উপাদান ফুসফুস, ব্লাডার, লিমফোমা ও স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। এতে আরও রয়েছে বিপুল পরিমাণ ক্যান্সার ফাইটিং ফাইটো নিউট্রিয়েন্টস।
৮। তরমুজ
ফলের মধ্যে তরমুজ অনেক উপকারি। এই তরমুজের এক টুকরাতে প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, প্রতিদিনের চাহিদার ৮০% ভিটামিন সি, ৩০% ভিটামিন এ ও বিটা ক্যারোটিন বিদ্যমান থাকে। তাছাড়া তরমুজেও লাইকোপেন থাকে যা ক্যান্সারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারে। বর্তমান এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, ফল ও শাকসবজিতে ফুসফুস, মুখের, খাদ্যনালীর এবং কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকির মুক্তি পাওয়া যাবে।
৯। সবুজ শাক
সবুজ শাক ফাইবার, ফোলেট, ক্যারোটিনয়েড ও ফ্লেভনয়েডের চমৎকার উৎস। এই যৌগ গুলোর বেশীর ভাগেরই অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপকারিতা আছে যা কোষকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে থাকে। ফলে ক্যান্সারের প্রতিরোধে সবুজ শাক অনেক উপকারি। তাছাড়া Lutein and zeaxanthin নামক ক্যারোটিনয়েড চোখের প্রতিরক্ষার কাজ করে এবং মেকুলার ডিজেনারেশন এর ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। যার কারণে অন্ধতার সমস্যা হতে পারে। ফলে বেশি বেশি করে সবুজ শাক সবজি খাওয়া ভাল।
১০। জাম জাতীয় ফল
স্ট্রবেরি, ব্লু বেরি এবং ব্ল্যাক বেরি হচ্ছে সত্যিকারের সুপার ফুড। এই সকল ফলে চিনি কম থাকে ও পুষ্টিতে সমৃদ্ধ থাকে। তাঁদের স্পন্দনশীল রঙের অর্থ এরা অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে ভরা, এর পাশাপাশি ফ্লেভনয়েড এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ভিটামিন ও থাকে। এই অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হৃদপিণ্ডের সুরক্ষা প্রদান করে এবং এর ক্যান্সার বিরোধী প্রভাব আছে। এছাড়াও শরীরের নিজস্ব অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এনজাইমকে উদ্দীপিত করে। জাম জাতীয় ফল খেলে ডায়াবেটিস, ক্যান্সার এবং cognitive decline এর ঝুঁকি হ্রাস করে এবং স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি করে। সুতরাং জাম জাতীয় ফল শরীরের জন্য অনেক উপকার।
১১। পিঁয়াজ
নিয়মিত রসুন খেলে পাকস্থলীর ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি কমে যায়। পুষ্টিবিদদের মতে পিঁয়াজেরও রয়েছে ক্যান্সার প্রতিরোধক উপাদান যা টিউমারের বেড়ে ওঠাকে বিলম্বিত করে। সুতরাং রান্নার ক্ষেত্রে পিঁয়াজ অনেক উপকারি।
১২। মাশরুম
আধুনিক খাবার হিসেবে বাংলাদেশে মাশরুমের ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটছে। যে-সকল ব্যক্তি মাশরুম সংগ্রহ করে খায়, তারা মাইকোফেজিস্টস বা ‘মাশরুম খাদক’ হিসেবে পরিচিত। মাশরুম খোঁজার প্রক্রিয়াকে সাধারণতঃ মাশরুমিং বা মাশরুম শিকারী নাম বলা হয়। মাশরুমে রয়েছে ক্যান্সার প্রতিরোধী উপাদান। এছাড়াও রয়েছে পুষ্টি ও ভেষজগুণ যা রোধ করবে ক্যান্সার।
১৩। বেদানা
ডালিম দেহের শ্রেষ্ঠতম হিতকর ফল। এ ফল কোষ্ঠ রোগীদের জন্য উপকারী বলে মনে করা হয়। গাছের শিকড়, ছাল ও ফলের খোসা দিয়ে আমাশয় ও উদরাময় রোগের ওষুধ তৈরি হয়। ইহা ত্রিদোষ বিকারের উপশামক, শুক্রবর্ধক, দাহ-জ্বর পিপাসানাশক, মেধা ও বলকারক, অরুচিনাশক ও তৃপ্তিদায়ক। ডালিমের ফুল রক্তস্রাবনাশক। ডালিমে বিউটেলিক এসিড, আরসোলিক এসিড এবং কিছু আ্যলকালীয় দ্রব্য যেমন- সিডোপেরেটাইরিন, পেপরেটাইরিন, আইসোপেরেটাইরিন, মিথাইলপেরেটাইরিন প্রভৃতি মূল উপাদান থাকে। এই ফলটি বিভিন্ন রোগ উপশমে ব্যবহার হয়। এছাড়া বেদানায় ক্যান্সার প্রতিরোধী উপাদানের পাশাপাশি এতে রয়েছে পর্যাপ্ত পরিমাণ এন্টিইনফ্লামেটরি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট।
১৪। কালো চকলেটে
কালো চকলেটেও রয়েছে এন্টি ক্যান্সার প্রপার্টি। ডার্ক চকলেটের পলিফেনলস ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়ক। তাছাড়া কালো চকলেট বা ডার্ক চকলেট নিয়ে একাধিক গবেষণায় বিশেষজ্ঞগণ দেখেছেন কালো চকলেট রক্ত জমাট বাঁধতে বাধা দেয়, রক্তচাপ কমাতেও সাহায্য করে এবং রক্তনালী কোমল রাখে তাই হার্টের জন্য ভালো। তবে অধিক চকলেট খাওয়া যাবে না।
১৫। সামুদ্রিক মাছ
সামুদ্রিক মাছে ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড হৃদযন্ত্রকে সক্রিয় ও কার্যক্ষম রাখতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড হৃদযন্ত্রের রিদমকে দ্রুততর করে, ধমনীতে চর্বি জমার মাত্রাকে কমিয়ে দেয়, ধমনীতে পুরনো প্রদাহকে ঠাণ্ডা রাখতে এবং রক্তচাপকে স্বাভাবিক রাখতে সহায়ক। গবেষকেরা জানিয়েছেন হৃদরোগের ঝুঁকি কমানোর জন্য প্রতি সপ্তাহে একজন মানুষের ১৭৫০ মিলিগ্রাম ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড দরকার পড়ে। আর এই সামুদ্রিক মাছের মধ্যে বিদ্যমান থাকা ওমেগা-৩ ফ্যাট এসিড যা প্রদাহ প্রতিরোধ করে ফলে দেহের ক্যান্সারের রূপ নিতে বাধা দেয়।
১৬। খেজুর
ক্যান্সার প্রতিরোধ অবাক হলেও সত্য খেজুর ক্যান্সার প্রতিরোধ করে। এক গবেষনায় দেখা যায় খেজুর পেটের ক্যান্সার প্রতিরোধ করে। আর যারা নিয়মিত খেজুর খান তাদের বেলায় ক্যান্সারের ঝুঁকিটা কমে যায় অনেকখানি।
এছাড়াও বীজ, দই, বাঁধাকপি ইত্যাদির ও ক্যান্সার বিরোধী কার্যকারিতা আছে। তাই আমাদের সকলের উচিত নিয়মিত এই খাবারগুলো খাদ্য তালিকায় যেন রাখি।
No comments